বালু-পাথর মহালে ইজারা পদ্ধতির বিকল্প ভাবনা
- আপলোড সময় : ১০-১১-২০২৪ ০৮:৫২:২১ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১০-১১-২০২৪ ০৮:৫২:২১ পূর্বাহ্ন
ইকবাল কাগজী
বেশ কয়েক বছর যাবৎ প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতাকে রোধ করতে গিয়ে ধোপাজান-চলতি নদী ও যাদুকাটা নদীর বালু-পাথর মহাল ইজারা দেওয়া বন্ধ আছে। দেশের পরিবেশবাদীরা এতে সায় দিয়েছেন। এদিকে সমালোচকেরা একে মাথাব্যথা বন্ধ করতে গিয়ে মাথাকেই কেটে ফেলার সামিল মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, ‘মহালে ইজারা বন্ধ মানে শ্রমিকের কর্মসংস্থান বন্ধ, কিন্তু বালুপাথর লুণ্ঠনের অবাধ সুযোগ প্রদান। ইজারা বন্ধের ফলে বাস্তবে বারকি শ্রমিকরা নদীতে বালু আহরণে নামছেন না, অপরদিকে শতশত ড্রেজারে বোমামেশিন সহযোগে বালু উত্তোলন চলছে, প্রশাসনের নাকের ডগায়। প্রশাসন বাধা দিচ্ছে না বরং বখরা আদায় করছে। বাস্তবতা এটাই। বালু লুণ্ঠনের বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আচরণটিকে তাই কেউ কেউ ঝড়ের মুখে পড়া উটপাখির বালুর নিচে মাথাগুজার সঙ্গে তুলনা করছেন। অর্থাৎ ইজারা বন্ধ রাখার কল্যাণে কিন্তু বালুপাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এমন নয়, বরং এই ক’দিন আগে আন্দোলনের মুখে অবৈধ উত্তোলন বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রশাসনের প্রশ্রয়পুষ্ট হয়েই লুটপাটের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। ইতোমধ্যে গণমাধ্যমান্তরে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন থেকে এমনটাই প্রতিপন্ন হয়, দৃষ্টান্ত দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাঁশ পুঁতে চলতি নদীর মুখে বেড়া দেওয়া হয় এবং কতিপয় পুলিশ প্রহরায় রাখা হয়। পুলিশি প্রহরা উপেক্ষা করে পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের নাকের ডগায় বাঁশের বেড়া ভেঙে বিভিন্ন প্রকার-আকারের নৌকা নদীতে ঢুকে বালু লুটপাট করে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে ইজারা দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে বটে কিন্তু কার্যত বালু-পাথর লুটপাট বন্ধ করা হয়নি এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার কোনও গরজ অন্তত সরকারের নেই সেটাও প্রতিপন্ন করা হয়েছে। এই হলো সুরমার উত্তর পাড়ের ‘বালুমিশ্রিত পাথর মহাল’-এর বাস্তব অবস্থা।
এই অবস্থার জন্য দায়ি ইজারা প্রথা। সরকারই এই ইজারা প্রথাকে রাজস্ব আদায়ের নামে বাস্তবায়িত করেছে এবং প্রকারান্তরে শোষক শ্রেণির একাংশকে প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে লক্ষগুণ রাজস্ব প্রাপ্তির সুযোগকে জলাঞ্জলি দিয়েছে জেনেবুঝেই। অবশ্যই না বোঝার কোনও অবকাশ নেই, সাধারণ বারকি শ্রমিকরা যদি বোঝেন এবং সরকারি স্বার্থ রক্ষার্থে আন্দোলনে পর্যন্ত নামেন, তবে সংশ্লিষ্ট সরকারি নীতিনির্ধারকরা কেন বুঝবেন না। তাঁরা তো বারকি শ্রমিকদের মতো অশিক্ষিত নন। বারকি শ্রমিকরা বার বার রাজস্ব ফাঁকির ফাঁকফোঁকড় ও রাজস্ব ফাঁকির পদ্ধতি ও তার কারণ দেখিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন, সেইসব স্মারকলিপি সরকারি নীতিনির্ধারক মহলের কাছে কখনই পাত্তা পায় নি।
অতীতে চলতি নদী বা যাদুকাটা নদীর গভীরতা শুকনো মৌসুমে প্রায় সর্বত্রই বড়জোর দেড়/দুই ফুটের মতো হয়ে পড়তো এবং কোথাও কোথাও বেশি করে হলেও তিন/চার ফুটের অধিক হতো না। এই কারণে এতদঞ্চলে কম গভীর জলে চলাচলযোগ্য বারকিনৌকার প্রচলন হয়েছে বালুপাথর সহজে পরিবহণের জন্যে। বর্ষা মৌসুমে এই নাব্যতা বড়জোর ২/৩ গুণ বাড়তো। নদীর তলদেশ থেকে ড্রেজার ও অন্যান্য আধুনিক খননযন্ত্র সহযোগে গভীরতাকে বালি পাথর উত্তোলনের জন্য ক্রমাগত খনন করতে করতে কমপক্ষে ৪০ ফুট থেকে কোথাও কোথাও ৭০/৮০ ফুটের অধিক করে ফেলা হয়েছে এবং নদীর প্রস্থ আগেকার স্বাভাবিক প্রস্থের তুলনায় তুলনাহীনভাবে বেড়ে গিয়ে দেড়/দুই কিলোমিটারকেও ছাড়িয়ে গেছে। এমতাবস্থায় নদীর দুই পাড়ে বিস্তৃত জনবসতির কতো স্থাপনা, ফসলি জমি ও বনসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা কতোটা বেড়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা এখানে সম্ভব নয়। বোধ করি তার জন্য অলাদা একটি মহাভারত রচনা করতে হবে। সেটা সুবোধ বালকের বোধগম্য হলেও আমাদের প্রশাসকদের বোধগম্য হয় না এমন নয়। তাঁরা বোঝেন এবং না বোঝার ভান করে অর্থের থলির দিকে হাত বাড়ান।
সম্প্রতি ঘটেছে এমন একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ঘটনাটা আইনকে প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটের স্বার্থে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ইজারাদার কর্তৃক আদালতে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা প্রসঙ্গে। মহালগুলোতে যখন উপরে উক্ত বিপর্যয়কর অবস্থার বাস্তবতা বিরাজমান তখন একজন ইজারাদার সংশ্লিষ্ট উপরমহলের কাছে এইমর্মে দরখাস্ত করেছেন যে, ধোপাজান-নদী মহালের চারপাশে উজানের পাহাড় থেকে বালি নেমে এসে নদী-মাঠ-ঘাট ভরাট করে দিয়ে সুরমার উত্তরাঞ্চলকে মরুভূমি বানিয়ে দিচ্ছে। এই কারণে বালু উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়া হোক। তৎক্ষণাৎ সংশ্লিষ্ট উপরওয়ালার কাছে উক্ত অঞ্চলে বালু উত্তোলনের অনুমোদনে প্রণোদনা যুক্তিযুক্ত প্রতিপন্ন হয়েছে এবং যথারীতি তিনি অনুমোদন দিয়ে দিয়েছেন। নি¤œমহল থেকে যথাযথ অবস্থা অবগত করানো হলে উক্ত উপরওয়ালা তাঁর অধঃস্তনকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে নীরব থাকতে আদেশ করেছেন। জনস্বার্থে উদ্ভূত হয়ে জনৈক ব্যক্তির উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করা হলে অনুমোদন প্রক্রিয়াটি আপতত বিরত হয়। হাজার হাজার মানুষের আবেদন নাকচ করে দিয়ে একজন ইজারাদারের স্বার্থরক্ষার আবেদন ঠিকই গ্রহণ করা হয়। মিথ্যা তথ্যই তখন সত্যি হয়ে উঠে। এটা মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করা নয় বরং একটি সমাজে সহিংসতার সংস্কৃতি কায়েম রাখার প্রচেষ্টা মাত্র। যা যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে সমাজে ও বালুমহালগুলোতে বা এবংবিদ অন্যকোনও সম্পদের উৎসকে কেন্দ্র করে। এই কারণে শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজনের কাছে ‘ইজারা পদ্ধতি লুটপাটের লাইসেন্স’ ভিন্ন অন্য কীছু নয়।
আজ থেকে দশক তিনেক আগের কালে ‘বারণির চর’ বলে একটি চর ছিল। সেই বিশাল চরে পণাতীর্থের বারণি বসতো। এখন সেখানে সমুদ্রের ঢেউ খেলা করে। কেউ কেউ বলেন, সেখানে এখন গভীরতা নাকি ১০০ ফুটেরও অধিক । এদিকে বড়গোপ টিলা (বারেকের টিলা), শিমুল বাগ ইত্যাদি স্থান ও নির্মাণাধীন শাহ আরেফিন-অদ্বৈত সেতু নদীভাঙনে বিলীন হওয়ার হুমকির মুখে। অথচ উপরওয়ালা আমলা বালুচরের সমুদ্র হওয়ার পরও উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার ভয়ে ভীত। নতুন করে বালি উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়ার চমৎকার অজুহাত বটে। মিথ্যাকে এইভাবেই সত্যি করা হয় কাগজেপত্রে, বাস্তবে তা নাই বা থাকুক। এইভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয় কিংবা সমস্যা সরকারের প্রতিনিধিরা কেন বুঝেন না তার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। একটি যুক্তিযুক্ত কারণ অবশ্য আছে আর সেটি হলো স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, প্রকারান্তরে যা সম্পদ লুণ্ঠনের পথ তৈরি করে মাত্র।
এই ইজারা প্রথা কী সে সম্পর্কে সম্যক আলোচনা না করে বালুপাথর মহালে আসলে কী চলছে তা হৃদয়ঙ্গম করা সত্যিকার অর্থেই সাধ্যাতীত। সত্যি হলো মহালগুলোতে বালিপাথর উত্তোলনের পরিমাণ ইজারার চুক্তিপত্রে নির্ধারিত থাকে না। ইজারার চুক্তিপত্রে বালুপাথর উত্তোলনের জন্য জায়গার সীমা ইজারানীতির দ্বারা নির্দিষ্ট করা থাকে বটে কিন্তু উত্তোলনের পরিমাণ নির্র্দিষ্ট করা থাকে না এবং কার্যক্ষেত্রে যতোটুকু জায়গার ইজারা নেওয়া হয় তার চেয়ে শত শত গুণ বেশি পরিমাণ জায়গা ইজারাদার দখল করে নিয়ে সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করে। মাঠপর্যায়ে এই সীমালঙ্ঘন প্রতিরোধের কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, অন্তত হয়েছে বলে দেখা যায়নি। বিপরীতে বরং আইনের দোহাই দিয়ে ইজারাদারের পক্ষ হয়ে ইজারাদারের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনতার আন্দোলন দমনে পুলিশ মাঠে নামে। একদা হাওরাঞ্চলে ভাসানপানির আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তার প্রমাণ। নির্দিষ্ট সীমাবন্দি বিলের ইজারা নিয়ে বর্ষায় ভাসানপানির সমুদ্র দখলে নিত ইজারাদার, বিলের অবস্থান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের গ্রামে বন্যায় কৃষকের উঠোনে পানি উঠে গেলে সে-পানিতেÑ জাল তো দিল্লি দূরস্থÑ এমনকি বড়শির দ্বারাও মাছ ধরতে দিত না ইজারাদার, মারধর করতো। ভাসানপানিতে মাছ ধরার অধিকার প্রতিষ্ঠাটার আন্দোলনে জড়িত জেলেদেরকে খুন করে আইনের বদৌলতে অনায়াসে পার পেয়ে গেছে ইজারাদাররা, তার অনেক প্রমাণ আছে। আইন ইজারাদারের পক্ষেই দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়ায়নি এবং প্রমাণ করেছে সাধারণ মানুষের প্রাকৃতিক অধিকার আইনের দ্বারা বিশেষ শ্রেণির প্রভাবশালী ও ধনীইজারাদারকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এইভাবে প্রচলিত ইজারা আইনের দ্বারা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয় এবং পরিণতিতে নামমাত্র রাজস্বের বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ আহরণের সুযোগ লাভ করে ইজারাদার। প্রকারান্তরে লক্ষ টাকার মাল এক টাকায় বিক্রি করার বোকামির শিকারে পরিণত করা হয় রাষ্ট্রকে। গণিত যদি জানেন তবে ইচ্ছে হলে হিসেবে করে দেখতে পারেন। সরকার গণিত জানে না এমনটা বিশ্বাস করা অবশ্যই বোকামি। আসলে সরকার গণিত জেনেও না জানার ভান করে এবং ইজারাদারদেরকে অত্যন্ত কম দামে রাষ্ট্রের মাল বিক্রি করে তাকে ধনসঞ্চয়ের সুবিধা দেয় এবং নিজে সুবিধা নিয়ে প্রকারান্তরে প্রশাসন, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী মিলে রাষ্ট্রের সম্পদ লুটেপুটে খায়। এবংবিধ ব্যাখ্যা ব্যতীত এর অন্য কোনও যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা করা যায় না। যদি করা যায় তবে ব্যাখ্যাটা যে-কাউকে করে দেখাতে বলছি।
সরকারি নিয়মনীতির আড়ালে এবংবিধ কর্মকা-ের পরিসরে রাষ্ট্র ও সরকার পরস্পর প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা দেয় না কিন্তু সরকার রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে জনগণকে প্রতিপক্ষ করে তোলে শাসন-শোষণের রাজনীতিক প্রক্রিয়া বহাল রাখে। এতে প্রতিপন্ন হয় যে, রাষ্ট্র মূলত ‘একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির সংস্থা’ যা প্রতিপক্ষের সঙ্গে আপস করে না, আর বালুপাথর মহালের পরিসরে প্রতিপক্ষ হলো বারকিশ্রমিকেরা। সামগ্রিক অবস্থাটা এমন যে, বর্তমান আর্থসামাজিক পরিসরে র্ষ্ট্রা বা জনগণের সম্পদ আত্মসাতের এই নীতি সহজে পরিহার করা যায় না। বালুপাথর মহালে ইজারা প্রথা বাতিল করে বালুক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করতে প্রশাসন গড়িমসি করে, ক্রয়কেন্দ্রের ধারণাপ্রত্যয়টি প্রশাসনের বোধগম্যতায় আসে না। একটি নির্দিষ্ট স্থানে ব্যবসায়ীরা বারকিশ্রমিকদের কাছ থেকে বালুপাথর ক্রয় করবেন। একজন সরকারি প্রতিনিধি প্রতিদিনের বালুপাথরের বিক্রয়মূল্যের উপর সরকার কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত রাজস্ব আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেবেন। ব্যবসায়ী, বারকিশ্রমিক ও সরকারি প্রতিনিধি সংশ্লিষ্ট এই তিন পক্ষের কাছেই মাল বিনিময়ের রশিদ থাকবে। এই সহজ প্রক্রিয়াটি রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের মগজে ঢুকে না, বিশ^াস করি না বরং মনে করি, তাতে তাঁরা বাড়তি মূল্য (অসলে উদ্বৃত্তমূল্য, যাকে ইংরেজিতে ‘সারপ্লাস ভ্যালু’ বলে) আহরণের সুযোগ থাকে না বলে না-পছন্দ করেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় বা জনসম্পদ আত্মসাতের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে বুঝেও বুঝতে চান না, না বুঝার ভান করেন। একজন হিসেব করে দেখিয়েছেন জনসম্পদ আত্মসাত প্রতিরোধে নিয়োজিত হয়ে ১০০ কোটি টাকার বালু লুট ও ২ কোটি টাকার চাঁদাবাজি (সম্প্রতি ধোপাজান-চলতি নদীর মহালে যা সংঘটিত হয়েছে) বন্ধ করে এই পরিমিত বালু থেকে ভ্যাট ও ট্যাক্স হিসাব করে আদায় করা হলে বৎসরে ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব এবং সিলেটের ৮টি মহাল হতে ৪০০০ কোটি টাকা অনায়াসে আদায় হতে পারে। সুতরাং ক্রয়কেন্দ্রের বদলে ইজারাব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত হলে এই আত্মসাৎ কিংবা কাঠামোগত সহিংসতা যা’ই বলি না কেন, চলতেই থাকবে, অবসান কখনওই ঘটবে না, যা হবার তাই হবে এবং কী কী হয় কিংবা হবে নি¤েœ তা সংক্ষেপে তোলে ধরা হলো।
এক.শকুনের দৃষ্টি মরা গরুর প্রতি নিবদ্ধ থাকে, বালুপাথর মহালের প্রতি তেমনি দৃষ্টি থাকে সমাজের প্রভাবশালী ধনকুবেরদের এবং প্রকারান্তরে রাজনীতিক সমাজের আধিপত্য কিংবা কাঠামোগত সহিংসতার বিস্তার ঘটে মহালে মহালে।
দুই. ইজারা চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে ইজারাদার যে-পরিমাণ রাজস্ব রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমার করে টাকার পরিমাপে তার চেয়ে মহালের হাজারগুণ ক্ষতি সাধন করে। তাতে রাজস্ব প্রাপ্তির পরিমাণের চেয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ হাজারগুণ বেশি হয়, নীতিগতভাবে যে-সম্পদের মালিক সরকার বা জনগণ। কিন্তু ইজারা চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের প্রতিকার না হয়ে ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত সরকারকা মাল দরিয়ামে ঢাল হয়ে পড়ে জনগণের মাল বেহাত হয়ে ধনকুবেরর সম্পদের ভা-ার বড় করে তোলে।
তিন. মহালে স্টিলবডি নৌকার প্রবেশ ও ড্রেজারবোমা ব্যবহার করে বালুপাথর উত্তোলনের কারণে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি পায় ও নদীভাঙনের সূত্রপাত করে, বন ও বসতি উজাড় হয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতাকে অনিবার্য করে তোলে এবং বারকিশ্রমিকরা বেকার হয়ে কাজের সন্ধানে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায় অর্থাৎ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।
চার. ইজারাদার তার বাণিজ্যস্বার্থ রক্ষার্থে মহালের চারপাশে লুম্পেন চরিত্রের গুন্ডাপোষণে সক্রিয় হয়, এতে অপরাধ প্রবণতা বাড়ে এবং অপরদিকে অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ার সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে। এই অবস্থায় সমাজে ঘুষ, দুর্নীতি, দখল, চাঁদাবজি, জালিয়াতি, প্রতারণা, ভ-ামি, গুন্ডামি, সন্ত্রাস, বৃদ্ধি পেয়ে কাঠামোগত সহিংসতার আর্থসামাজিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এবংবিধ সহিংসতার কোনও একক হোতাকে চিহ্নিত করা যায় না।
এখন মহালগুলোতে কী করতে হবে সাতিশয় সংক্ষেপে তার দিকনির্দেশনা নি¤েœ উদ্ধৃত হলো :
এক.নির্দিষ্ট স্থানে সরকারিভাবে বালুপাথর ক্রয়কেন্দ্র চালু করা।
দুই. বালুপাথর ব্যবসায়ীদেরকে সরকারিভাবে লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়ার আওতায় আনয়ন করা।
তিন. সরকারি কোষাগারে ভ্যাট, ট্যাক্স ও রয়েলিটি জমাকরণের কার্যকর ব্যবস্থা করা।
চার. বালুপাথর বোঝাই করা জাহাজ, বাল্কহেড, স্টিলবডি নৌকা নির্দিষ্ট ঘাটে নোঙর করাসহক্রমনির্ধারণ কার্যকর (সিরিয়াল নাম্বার ফেলা) করা।
পাঁচ. বালুপাথর উত্তোলনের পরিমাণ নির্ধারণ করা।
ছয়. সনাতন পদ্ধতিতে শুধুমাত্র কাঠবডির বা বারকিনৌকা দিয়ে বালতি, বেলচা ও নেটের মাধ্যমে বালুপাথর আহরণের ব্যবস্থা করা।
সাত. শুধুমাত্র উত্তোলনযোগ্য স্থানে বালুপাথর আহরণের কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে উত্তোলনযোগ্য স্থানে সরকারি লোকদ্বারা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর করা।
আট. বর্ষাকালে নদীর পাড় কাটা রোধকল্পে বালুপাথর আহরণ বন্ধ রাখা এবং কাজ বন্ধ রাখার সময়ে শ্রমজীবী মানুষের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা।
নয়. বালুপাথর শ্রমিকের তালিকা তৈরি করা ও পূর্বের মত বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে কাজে শৃঙ্খলা আনা ।
দশ. ক্যাপাসিটির অধিক শ্রমিক হলে একদিন অন্তর অন্তর কাজের নিয়ম চালু করা।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ